নাম দিতে পারলাম না

প্রতিষ্ঠানটির সাথে ছেলেটির সম্পর্ক দীর্ঘ ১০ বছরের, সেই ২০০০ থেকে শুরু করে ২০১০ পর্যন্ত। কিন্তু আজও ছেলেটি মনে করে সে এখনও ঐ প্রতিষ্ঠানের অংশ, সুযোগ পেলে শুধু মন চায় ছুটে যেতে, কিছুটা সময় প্রতিষ্ঠানটির বারান্দা দিয়ে হাঁটতে। এই বারান্দা গুলো দিয়েই যেন তার বড় হওয়া, কখনও ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, কখনও ফাইল হাতে নিয়ে হাটা, কখনও টিফিন এর মাঝে দৌড়ানো আবার কখনও শাস্তি পেয়ে দাড়িয়ে থাকা, কিভাবে কেটে গেল ১০ টি বছর তা আজও ছেলেটি চিন্তা করে বুঝে উঠতে পারেনি।

২০০০ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে, একটি জ্যাকেট, সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে ছেলেটি গুঁটি গুঁটি পায়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। কি পরিশ্রমটাই না করতে হয়েছে এখানে আসার জন্য। বিগত ৬ মাস স্কুল এর পাশাপাশি মোহাম্মাদপুর পোস্ট অফিস এর পিছে এক জায়গায় কোচিং করতে হয়েছে ছেলেটিকে। বাংলায় বরাবর কাঁচা ছেলেটিকে অঙ্ক করতে হয়েছে বাংলায়, লিখতে হয়েছে কত অজস্র প্যারাগ্রাফ। কি কারনে তাকে এত পড়ালেখা করা লাগছে, তা ছেলেটি ঐ সময় বুঝেনি, শুধু মা কে খুশি করার জন্য পড়ে গিয়েছে এবং ভর্তি পরীক্ষা অতিক্রম করে সুযোগ ও পেয়ে গেল প্রতিষ্ঠানটিতে যাওয়ার। ফল প্রকাশের দিন, মায়ের আনন্দ দেখে ছেলেটি বুঝতে পারলো যে তার পরিশ্রম সার্থক এবং সে অনুভব করলো যে তার মনের ভিতরেও এক ধরনের প্রফুল্লতা যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি।

ফিরে আসি আবার জানুয়ারী মাসে, ছেলেটি এখন লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে আরও অনেকজনের সাথে। তার মতই সবাই সাদা শার্ট আর বিভিন্ন রঙের প্যান্ট পরে আছে, সাথে জ্যাকেট অথবা সোয়েটার। বাম পাশে তাকিয়ে খেয়াল করল আরও অনেক গুলো লাইন, বড় ছোট মিলিয়ে এক হুলস্থূল ব্যাপার। এত বড় মাঠে এত ছাত্রের assembly ছেলেটি কখনও দেখে নি। আরও খেয়াল করে দেখল, সবার শার্ট এর পকেট এর উপরে একটি মনোগ্রাম, ছেলেটিও কয়েকদিন এর মধ্যে সেই মনোগ্রামটি পেল আর আগামি ১০ বছর তা ছিল ছেলেটির বুকে, গর্বের সাথে পরিচয় দিয়েছে যে সে এই প্রতিষ্ঠানটির ছাএ।

Prefect উপাধির এক বড় ভাইয়া যার নাম সোহেল, তাদেরকে লাইন ধরে ক্লাস এ নিয়ে গেল। Class 3 Hawks, Roll 36. ক্লাসরুম টা ছিল অন্য রকম, বিশাল একটা ব্ল্যাকবোর্ড, গোল গোল ৬ টি লাইট, অগনিত জানালা, এব্র-থেব্র ছাঁদ, একটি আলমারি, যার ভিতরে কি ছিল তা জানার কৌতূহল এর শেষ ছিল না ছেলেটার। আগে থেকেই class teacher উপস্থিত, Francis P. Rozario. যেমন পরিপাটি, তেমন স্মার্ট, কথা শুনে মনে হল উনি অনেক বছর বিদেশে ছিলেন। English Literature পরাবেন তিনি, প্রথম দিন বলে, স্কুল এর অনেক নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিলেন, Good Morning Sir/ Madam, Salute 1, Salute 2 Practice করালেন। স্যার কে বড্ড ভয় করত ছেলেটি, কিন্তু অনেক সম্মানও করত। উনার ইংল্যান্ড ভ্রমনের রোমাঞ্চকর গল্প উদগ্রীব হয়ে শুনত আবার বাসায় এসে মা কে বলত। স্যার কে খুশি করার জন্য বাবাকে অনেক বুঝিয়ে Yearly Magazine এর জন্য একটি বিজ্ঞাপন এর ব্যবস্থা ও করে। স্যার খুশি হয়ে ক্লাস এ সবার সামনে দাড় করিয়ে ধন্যবাদ জানান। কি এক মধুর স্মৃতি!

২য় পিরিয়ড এ ক্লাস নিতে আসলেন নারগিস ম্যাডাম। সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাস নিবেন তিনি। আবার ইসলাম শিক্ষা ক্লাসটিও ঐ বছর উনি নিয়েছিলেন। ম্যাডাম এর কথা ছেলেটি কম বুঝতে পারত, কিন্তু অনেক যত্ন নিয়ে পরিয়েছিলেন তিনি। Detention Slip দেখিয়ে প্রায় ভয় দেখাতেন তিনি, কিন্তু কখনও ছেলেটি উনাকে detention দিতে দেখেনি। অঙ্ক ক্লাস নিতে আসলেন মধু স্যার। স্যার কে এখনও ভয় পায় ছেলেটি, প্রথম ক্লাস এ স্যার ২০ x  ২০ নামতা শিখিয়েছিলেন, প্রথম ক্লাস টেস্ট ও হয়েছিল নামতার উপর। ১০ এ ১০ পেয়ে ছেলেটির খুশি দেখে কে! স্যার বিশাল আকারের স্কেল, কম্পাস এনে বোর্ড এ জ্যামিতি আঁকতেন, কেও ক্লাস এ কোন নিয়ম ভাঙলে আবার ওইটা দিয়েই মারতেন!! স্যার কে সব চেয়ে বেশি মনে রাখে ছেলেটি কারন স্যার assembly করাতেন। BOYS COME TO ALERT! ATTENTION! SALUTE! ছেলেটির কানে এখনও ভাসে!

এরপর English Language ক্লাস নিতে আসেন রায়হান স্যার। উনাকে predict করা একেবারেই ছেলেটার সাধ্যের বাইরে ছিল। রেগে গিয়ে ছেলেটার এক সহপাঠীকে খুব মারধর করলেন একদিন, এমনকি তার বই খাতা ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিলেন। পর মুহুরতেই ক্লাস ক্যাপটেন কে পাঠালেন সেই খাতা নিয়ে আসতে আর ছেলেটার সহপাঠীকে কাছে ডাকলেন। সে তো ভয়ে আগায় না, পরে স্যার নিজেই কাছে টেনে নিলেন, জড়ায় ধরে আদর করে বললেন, “তুই এরকম হাগুর মত আচরণ করিস কেন?” এই বলে পকেট এ ১০ টাকার নোট গুজে দিয়ে বললেন টিফিন এ একটা কোক খেয়ে নিবি। ছেলেটাও একদিন রায়হান স্যার এর ঝড় এর শিকার হয়। ক্লাস এইট এর ছাএ তখন, নতুন নতুন ক্লাস ফাঁকি দিয়া শিখেছে। লাইব্রেরিতে কাজের অজুহাত দিয়ে ক্লাস এ ১৫ মিনিট পরে আসে, স্যার কে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে যে তার কাজ কতটা জরুরি ছিল, কিন্তু বরাররের মতন স্যার কে predict করতে পারে না ছেলেটা, হঠাৎ একটা মাংসল তালু তীব্র বেগে আঘাত হানে, ছেলেটার ডান গালে, চোখে সরষে ফুল দেখতে দেখতে ফিরে যায় নিজ আসনে। সেই থাপ্পর এর কথা চিন্তা এখনও মাথা ভন ভন করতে থাকে ছেলেটার। পরে বাকিদের কাছে শুনেছে স্যার নাকি কাছে এসে মাথায় হাত বুলায় দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঘটনার পরের কিছু মিনিটের সৃতি ওর আর মনে নেই।

 টিফিন মানেই ছিল কে কার আগে দৌড়ায় ক্যান্টিন এ যাবে। পিটার’স ক্যান্টিন এর সাথেও ছেলেটির কত সখ্য। ৯ টাকা দিয়ে বার্গার-চপ , কিংবা ২ টাকার সিঙ্গারা অথবা ১০ টাকার ভেজিটেবল রোল, চিন্তা করতে করতে মন খারাপ হয়ে যায় ছেলেটার। শুনা যায় পিটার এর ক্যান্টিন নাকি আজ আর নেই, টিফিন এ, স্কুল এর আগে পরে, প্র্যাকটিকাল এর শেষে, টার্ম পরিক্ষা শেষে কত সময়ই না কেটেছিল ক্যান্টিন এর সামনে।

 

টিফিন এর পরে ক্লাস নিতে আসলেন সাবেরা ম্যাডাম। বাংলা ১ম পত্র। ক্লাস টেন পর্যন্ত সাবেরা ম্যাডাম কে পেয়েছে ছেলেটা, ছোট বেলায় যে আদরটা করতেন, বড় হয়েও তার কোন কমতি চোখে পরেনি কখনও। বাংলা থেকে শুরু করে, বিজ্ঞান, সমাজ কত কিছুই না পরিয়েছেন ম্যাডাম, কত যত্ন করে, কত ধৈর্যের সাথে, চিন্তা করলেই মনে হয় ছেলেটি কত ঋণী উনার প্রতি। পরবর্তীতে জেসিএফ এ ম্যাডাম এর সাথে খুব কাছে থেকে কাজ করার সুযোগ হয় ছেলেটার, উনাদের হাতে গড়া ক্লাব গুলা আজকে কি অবস্থায় আছে জানতে খুব মন চায়।­­­

শেষ পিরিয়ডে ক্লাস নিতে আসতেন ফারিদ স্যার। হাতের লেখা ও ড্রয়িং! স্যার যে কতটা বস পাবলিক, ছেলেটা ঐ সময় ধারনাই করতে পারেনি। ক্লাস টেন এ এসে শেষ পর্যন্ত স্যার এর ধর্ম ক্লাস পায় সে, কিন্তু ততদিনে স্যার এর সাথে অনেক সময় কাটিয়ে ফেলে। পড়া না পারলে ডায়েরি তে কমেন্ট লিখা এই স্যারকে খেলার মাঠে দেখলে কেও চিন্তে পারবে না। কি ক্রিকেট কি ফুটবল কি ভলিবল, যে কোন খেলায় তিনি সবার আগে। ফারিদ স্যার ছাড়াও ছেলেটি পেয়েছে বারী স্যার, আজিজ স্যার ও মাসুম স্যার কে। মাসুম স্যার এর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এসএসসি এর ২ মাস আগে বড্ড বিপদে পরে গিয়েছিল ইসলাম শিক্ষা নিয়ে। স্যার অনেক সময় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যা ছেলেটি কোনদিন ভুলবে না।

এছাড়াও ক্লাস নিতেন ব্রাদার চন্দন ও নিশাত ম্যাডাম। ব্রাদার চন্দনের সাদা রোব নিয়ে কৌতূহল এর শেষ ছিল না ছেলেটার। সাবজেক্ট এর বাইরেও অনেক কিছু নিয়ে জ্ঞান দিতেন ক্লাস এ। কিছু দিন এর মধ্যেই অবশ্য উনি চলে যান অন্য এক প্রতিষ্ঠানে।

দেখতে দেখতে ১ বছর পার হয়ে যায় ছেলেটির। পড়ালেখায় ও খারাপ করে না। উঠে পরে ক্লাস ফোর এ, 4 Lions, Roll 09. প্রথম ক্লাস নিতে আসলেন রেহানা ম্যাডাম। ম্যাডামের ব্যাপারে ছেলেটি প্রথম পড়ে স্কুল ম্যাগাজিনে। এক বড় ভাই ম্যাডামের হাসি কে হাসনাহেনা ফুলের বাগানের সাথে তুলনা করেন, ছেলেটা এই তুলনার মর্ম খুব একটা বুঝতে না পারলেও ম্যাডামের হাসি তার কাছে অনেক ভাল লাগতো। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মত কঠিন বিষয় গুলো উনি অনেক সহজ করে ছাত্রদের পড়াতেন। কিন্তু ছেলে বরাবরি বাংলায় দুর্বল, শেষ দিন পর্যন্ত কোনরকম পাস করতে পারলেই খুশি ছিল। ম্যাডামের কাছেও ছেলে অনেক ঋণী একটি ছোট ঘটনার কারনে। ক্লাস নাইনে পড়ে তখন। বিভিন্ন ক্লাবের কাজে মহা ব্যস্ত সে। বলা বাহুল্য প্রথম টার্ম পরীক্ষায় রেজাল্ট পুরা গোল্লা, এতগুলো ছাত্রের মাঝেও ম্যাডাম ঠিকই খুজে বের করলেন ছেলেটিকে, “কি বাবা? তোমার রেজাল্ট এর এই হাল কেন? ক্লাস নাইনে উঠে কি পাখা গজায় গেল নাকি?” এইটুকু কথায় কাজ হল, ছেলে আবার মনোযোগ দিল পড়ালেখায়।

বাংলার তিন জাহাজ ছিল স্কুলে। রেহানা ম্যাডাম ছাড়া ছিলেন হরষিত স্যার ও বণিক স্যার। ছেলেটি তার জীবনের প্রথম detention পায় এই হরষিত স্যার এর কল্যাণে। আপরাধঃ ক্লাস টেস্ট এর খাতা বাসা থেকে সাইন করে আনার ব্যর্থতা, ছেলেটারও বা দোষ কি? ১০ এ ৩ পাওয়া খাতা বাসায় দেখাতে যে বুকের পাটা লাগে, সেটা তো তার নেই। যে কোন পরীক্ষাতে গার্ড দিতে স্যার এর প্রস্তুতি ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। উনি একদিন পরীক্ষার আগে, একটা সানগ্লাস পরে, একটা বেঞ্চের উপর এক পা তুলে দাড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, “আমি এখন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছি!” ক্লাস টেন এ হাজার বছর ধরে উপন্যাস এর উপর objective পরীক্ষা। গণ্যমান্য ছাত্ররা সেই পড়া দিয়ে আসছে, যে কোন প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা আছে। পরীক্ষার প্রথম প্রশ্ন, কার চোখের কোণে জল? পুরা উপন্যাস ১০ বার পরেও উত্তর বের করতে পারে নাই 10 Stars এর বাঘা বাঘা ছাএরা। পরে স্যারই উত্তর দিলেন, “ছাগল ছানাটির চোখের কোণে জল।“

 

বাংলার আরেক জাহাজ যার কথা না বললেই নয়, বণিক স্যার। ছেলেটি উনার কথা অনেক শুনেছে কিন্তু কোন ক্লাস পায় নি। শেষে ক্লাস টেনে এসে পেল স্যার কে, বাংলা ব্যকরণ পড়ালেন ছেলেটির ক্লাস এ। ছেলেটির একটি কথাই শুধু মনে হত, এই স্যার অন্য সকলের থেকে আলাদা, আর জ্ঞানের দিক থেকে যেন এক অথৈ সাগর। তিনি নিজেই দুঃখ করে বলতেন, তোমাদের ক্লাস আসলে আমার আরও আগে নিয়া উচিত ছিল। স্যার এর কথা শুনে ছেলেটি আসলেই মনে করতো, শিক্ষকতা যেন একটি পেশা নয়, নেশা!

ক্লাস ৫, ৬ আর ৭ এ ছেলেটি চমৎকার ধারাবাহিকতা অর্জন করে। তিন বছরই রোল ১২। 5 Hornets-Roll 12, 6 Wildcats-Roll 12 and 7 Jaguars-Roll 12.  এই সময় ছেলেটির মনে থাকা বহু দিনের একটি প্রশ্নের উত্তর পেল। প্রতিটি ক্লাস এ থাকা আলমারিটির ভিতরে কি থাকে? সেটার উত্তর দিলেন মাথিউস স্যার। উনি 5 Hornets এর ক্লাস টিচার, প্রথম দিনই বললেন সপ্তাহে একদিন গল্পের বই এর ক্লাস হবে, কিন্তু এত বই কই পাওয়া? স্যার তখন আলমারিটির দিকে তাকায় বললেন বই তো সব এইটার ভিতরে। অবশেষে আলমারির রহস্যের সমাধান হল। স্যার নিয়ম করে দিলেন, প্রত্যেক টার্মে সকলকে কম পক্ষে ২ টি করে বই donate করতে হবে। এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লাস এর ভিতরেই একটা চমৎকার বই এর সম্ভার হয়ে গেল আর সবাই নিয়মিত গল্পের বই পড়ত আবার donate ও করত। একই সুযোগ দিয়েছিলেন পাল স্যার ক্লাস ৭ এ। তাই 7 Jaguars এও একটা চমৎকার বই এর collection হয়েছিল। প্রায় ৪৫ বছর আগে যখন এই স্কুল বিল্ডিং এর পরিকল্পনা করা হয়, তখন কত কিছু চিন্তা করে করা হয়েছিল তা ভাবতেই অবাক লাগে। আর সেই চিন্তাধারাকে বাস্তবায়িত করার প্রয়াস এর জন্য অভিনন্দন মাথিউস ও পাল স্যারকে। ক্লাস দুইটির পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় চিন্তা করে ছেলেটি, সেই বই গুলো কি এখনও আছে? আজকে তো মাথিউস ও পাল স্যার নেই, কিন্তু তাদের সেই বই পড়ানর উদ্যোগ অন্য কেউ কি নিয়েছে?

Class 6 Wildcats, Roll 12: এই ক্লাস এ এসে ছেলেটি তার প্রিয় তিন টিচার কে পায়। স্কুল এ এইসময় নতুন আসেন হেনা ম্যাডাম এবং ঐ বছর উনি ছিলেন ছেলেটির ক্লাস টিচার। এরপরে 10 Stars এও উনি ক্লাস টিচার ছিলেন। উনাকে ক্লাস এ সবাই অনেক জ্বালিয়েছে কিন্তু তারপরেও হাসি মুখে পরিয়ে গিয়েছেন। এখনও দেখা হলে ম্যাডাম সবার খোজ-খবর নেন, ছেলেটির মনে হয় যেহেতু তারা প্রথম ব্যাচ ছিল, এই কারনে ম্যাডামও তাদের পছন্দ করতেন। ক্লাস ১০ এ যেকোনো বিষয়ে যেকোনো বিপদে পরলে, উনার কাছে চলে যেত ছেলেরা, উনিও সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন সকল সমস্যার সমাধান দিতে।

টিফিন এর বেল বাজার সাথে সাথে ছেলেটি দৌড় দেয় ক্লাস এর দিকে, সাথে তার সব বন্ধুরা কারন একটাই, মল্লিক স্যার এর ক্লাস। দেরি হলেই সর্বনাশ, কেন আর কিভাবে সেটা না হয় এখানে নাই বলি।

ছেলেটি শেষ বেঞ্চে বসে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে কাঁকদের বিচরণ দেখছিল আর জীবন নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বিশালাকার চক তীব্র গতিতে উড়ে আসে, ক্লাস এ পিন-ড্রপ নীরবতা, টুক করে একটা শব্দে শুনে কেপে উঠল ছেলেটা আর মাথায় হাত দিল, স্যার ক্লাস এর আরেক কোনায় দাড়িয়ে ডাক দিল, “চক নিয়ে সামনে আসো দেখি!” আজ পর্যন্ত স্যার এর টার্গেট খুব একটা মিস হতে দেখে নাই কেউ, মাঝে মাঝে মনে হত, স্যার কে বাংলাদেশ টিম এর ফিল্ডিং কোচ বানিয়ে দিলে হয়ত তারা আরও অনেক direct hit করতে পারত।

ছেলেটি আজকে অংকে বেশ ভালো, এই অংকের উপর ভর করে অনেক জায়গায় সুযোগ পেয়েছে। তার জন্য সম্পূর্ণ ক্রেডিট মল্লিক স্যার এর। উনি যেভাবে যত্ন নিয়ে, সময় দিয়ে বুঝিয়েছেন, পরিয়েছেন, তার জন্য ছেলেটি চিরকৃতজ্ঞ। সম্পাদ্য, উপপাদ্য গুলো যেভাবে পড়িয়েছিলেন, তা আজও ভুলে নাই ছেলেটা।

একটা সময় ছিল যখন ছেলেটা তার যেকোনো বিষয়ে মাহমুদ স্যার এর কাছে চলে যেত, আর স্যার ও সব সময় সাহায্য করতেন, পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে উথসাহিত করতেন। 9 Jets and 10 Stars, ছেলেটির স্কুল জীবনের সব চেয়ে আনন্দময় ও ঘটনাময় দুটি বছর। ছেলে তখন বিভিন্ন ক্লাব এর জন্য নিবেদিত প্রাণ। Scintilla Science Club, JDC, JCF সব জায়গায় ছেলেটি আছে, কিন্তু পড়া লেখা যে উচ্ছন্নে যাচ্ছে এইটা একমাএ মাহমুদ স্যারই ধরতে পেরেছিলেন। উনি এই দুই বছরই ছেলেদের Biology পড়াতেন তাই খুব কাছে থেকে বুঝতে পারতেন কে কেমন করছে। ক্লাস এর টেন এর প্রথম টার্ম পরীক্ষার পর parents-teachers meeting! ছেলেটির রেজাল্ট নিয়ে মা খুব চিন্তিত, তাই জীবনের প্রথম বারের মত ছেলে তার মাকে নিয়ে আসলো মিটিং এ। পরিকল্পনা করে প্রথমেই মাহমুদ স্যার এর কাছে নিয়ে গেল, কেননা biology এর রেজাল্ট বেশ ভালো। কিন্তু স্যার যে ভিতরের পুরো ঘটনা জানে, এইটা ছেলে ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করে নি! মিটিং থেকে বের হয়েই মা রওনা দিল বাড়ির উদ্দেশে, আর কোন টিচার এর কাছেও যাননি। সেই প্রথম এবং সেই শেষ!

ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ছেলেটি আবার স্কুল এ যায়। এসএসসির বৃত্তির একটি লিস্ট আসছে স্কুল এ। ঢাকা বোর্ড এর সেরা ১০০ ছাএ এর একটা লিস্ট ও আছে। স্কুলের যারা ঐ লিস্টে আছে, তাদের নাম হাইলাইট করে রাখা, অবাক হয়ে দেখে ছেলেটি, হাইলাইট করা নাম গুলোর মধ্যে সবার উপরের নামটি তার। সিঁড়িতে মাহমুদ স্যার এর সাথে দেখা! স্যার বেশ খুশি হয়ে বললেন, “তোমার একটা রেজাল্টের কথা শুনলাম! অভিনন্দন!” ঐ দিন স্যার না ছেলেটি, কে বেশি গর্বিত ছিল তা বলা মুশকিল!

ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টীমকে ছেলেটা খুব একটা পছন্দ করতো না, কিন্তু ক্লাস ১০ এ যখন পরে তখন ইন্ডিয়া কোন ম্যাচ জিতলে, খুশি হয়ে যেত। ইন্ডিয়া জিতা মানেই আজকে অঙ্ক ক্লাস এ কোন পড়া লেখা না হওয়ার সম্ভাবনা! কেশব স্যার যতই বকা দিয়ে অঙ্ক করাতেন, স্যার যে কি খুশি হত ইন্ডিয়া জিতলে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১১ সালে ইন্ডিয়া যখন বিশ্বকাপ জিতে, তখন ছেলেটার কত মনে হয়েছিল, “আজকে যদি ১০ Stars এ থাকতাম!”

Scintilla Science Club এর সাথে ছেলেটির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ক্লাস নাইন থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত, বহু সময় কেটেছে এই ক্লাব এর সাথে। সুযোগ পেয়েছে ক্লাব প্রেসিডেন্ট হওয়ার গৌরবের। আজকে সে প্রায় ২০০০ কর্মচারীর একটি কোম্পানি চালাচ্ছে, কিন্তু দল নেতা হয়ে কাজ করা, সময় মত সমগ্র resource এর পরিপূর্ণ ব্যবহার, কোন কঠিন কাজ এর পূর্বে উৎসাহ প্রদান, এগুলো সবই তো ছেলেটি শিখল chemistry lab এর ঐ কোণার রুমে বসে।

 ছেলেটির জীবনে দুটি মানুষের প্রভাব সব চেয়ে বেশি পরেছে। এক জন ছিলেন দত্ত স্যার। তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন একজন অভিভাবক। প্রতিটি টাকার মূল্য ছেলেটি শিখেছে স্যার এর কাছ থেকে। Chemistry lab এর প্রতিটি apparatus কে উনি নিজের সন্তান এর মত করে ভালবাসেন বলেছিলেন, ঐ দিন সবাই স্যার কে কিছুটা পাগল মনে করেছিল, কিন্তু আজকে ছেলেটি তার নিজের প্রতিটি প্রোডাক্ট গুলো একইরকম মনে করে, বুঝতে পারে স্যার এর কথা গুলো। Science Fair চলাকালীন সময়ে কোন একদিন ছেলেটিকে ভোর ৬ টায় স্কুলে যাওয়া লাগে একটি কাজ তত্তাবধায়নের জন্য। আশ্চর্য ব্যাপার, ছেলেটি আসার কিছুক্ষণ পরেই দত্ত স্যার চলে আসেন আর দুই জন মিলে কাজের তদারকি করে।  স্যার আজকে আর স্কুল এ নেই, মনে হয় ইন্ডিয়া চলে গিয়েছেন, তবে প্রতি বছর science fair এ ছেলেটি যখন বারান্দা দিয়ে হেটে যায়, বার বার স্যার এর কথা কানে ভাসে, “এই যে স্যার! যে কাজটির কথা কালকে বলেছিলাম ওইটা কি হয়েছে নাকি ওইটাও আমার করতে হবে?”

আরেক জন ছিলেন সুদেব স্যার। ছেলেটির ছাত্র জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন এই সুদেব স্যার। ২ টি বছর কলেজে  স্যার কে যেভাবে পেয়েছে, তা মনে হয় না আর কোনদিন কারও কাছ থেকে পাবে না। ছেলেরা সবাই বসে থাকতো অধীর আগ্রহে যে স্যার কখন ক্লাস নিতে আসবে পদার্থ বিজ্ঞান এর। স্যার এর বদলে অন্য কেউ আসলে শোনা যেত একটা চাপা ক্ষোভের অনুভূতি। Scintilla Club এর কাজের সময় স্যার কে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় ছেলেটি এবং বলা বাহুল্য আরও চমৎকৃত হয়। প্রতিটি বিষয়ে, বিপদে আপদে, সময়ে অসময়ে স্যার ছিল পাশে, কখনও সাপোর্ট দিয়েছেন, কখনও অভয় দিয়েছেন, আসলেই উনার মত মানুষ হয় না! কলেজ এর শেষ এর দিন, স্যার এর কাছে গিয়ে ধন্যবাদ চেয়েছিল, উনার কাছে এরপরেও অনেক বার গিয়েছে, কিন্তু কেন জানি ধন্যবাদ কথাটা মুখ দিয়ে বের হয় নাই। ধন্যবাদ স্যার!

ছেলেটি তার স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় ব্রাদার জন কে পেয়েছে অধ্যক্ষ হিসাবে। দূর থেকে দেখতে হয়েছে ব্রাদারকে, অনেকটা ভয় ও পেত। মাঝে মাঝে উনি assembly তে কিছু কথা বলতেন, তবে উনি যেদিন মারা যান, সেদিন কেঁদেছিল ছেলেটির ভিতরটা। কোন দিন বুঝতেও পারে নাই, এই অচেনা মানুষটা আসলে কত আপন। ব্রাদার লিও এর ব্যাপারটা আবার সম্পূর্ণ আলাদা, উনার কথা বার্তা বরাবরি straight forward এবং discipline এর ব্যাপারে অনেক কঠোর। তাই ছাত্ররা উনাকে খুব একটা পছন্দ করে নাই। গুটি কয়েকজন এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল আলাদা, তারা ব্রাদার লিও কেই পায় প্রকৃত অবিভাবক হিসাবে, ছেলেটিও তাদের মধ্যে একজন। ব্রাদার সব সময় co-curricular activities কে উৎসাহ দিতেন আর যে কোন বিপদে উনার কাছে direct চলে যাওয়া যেত। “সারাদিন তো দেখি ঘুরে ঘুরে বেরান। পড়া লেখা কিছু করছেন নাকি? সুদেব স্যার আপনার এই ছেলে পরীক্ষায় খারাপ করলে দায় দায়িত্ব কে নিবে?” রাখতে পেরেছিল ছেলেটি ব্রাদার এবং স্যার উভয়ের নাম, ১ম হয়েই কলেজ থেকে বের হয়। কোন এক রেজাল্টের দিন, uniform ঠিক ছিল না বলে, ব্রাদার ছেলেটিকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়, ঐ দিন উনি বলেছিলেন, “এক দিন বুঝবেন এই uniform এর মর্ম।“ আজকে ছেলেটি বুঝে, এখনও ২ সেট রাখা আছে ড্রয়ারের নিচে।

১০ বছরের কথা লিখে বলা অসম্ভব, কত জন আরও ছিলেন যাদের কথা বলা হল না। কৃষ্ণ স্যার, মিস্ত্রী স্যার, নির্মল স্যার, পলাশ স্যার, বিশ্বাস ম্যাডাম, মাহতাব স্যার সহ আরও অনেকে। প্রতি মাসে ছেলেটি অফিসে গিয়ে বেতন দিয়ে আসত বারনার্ড স্যারকে, registration এর যেকোনো কাজে যাওয়া লাগতো বেনেডিকট স্যার এর কাছে। মনে পরে কাশেম ভাই, জলিল ভাই, ইব্রাহিম ভাই, ভিনসেন্ট দা দের কথা!

ছেলেটির খুব শখ ছিল স্কুল ম্যাগাজিনে এইসব লিখবে, কিন্তু ঐ বয়সে এক যেমন সাহস হয় নাই, আবার না লিখে খুব একটা দুঃখ ও পায় নাই। কিন্তু আজ এই সময়ে এসে আর না লিখে পারলো না। দীর্ঘ ৫ মাস ধরে লিখে চলেছে ছেলেটি, যখন সময় পেয়েছে, ইচ্ছে হয়েছে, অল্প অল্প করে লিখেছে। লিখেছে শুধু প্রতিষ্ঠানটির কথা, লিখে নাই তার বন্ধুদের কথা, লিখে নাই একসাথে ১১০ জন এর বেড়ে উঠার কথা! সে আরেক গল্প, যা কোনদিন হয়ত লিখে শেষ করা যাবে না।

599099_10151397789177737_955548787_n

 

3 thoughts on “নাম দিতে পারলাম না

  1. This is just wow …..thank you for making such a thing….this actually has everything a Josephite would want to say and would remember after years ….this is really awesome – A josephite from batch 17 (school)

    Like

  2. I was a student at SJHS about four decades ago. What a wonderful experience. However, my recent visit after about 25 years turned out to be abhorring. I am sad how deteriorated the institution is compared to our times. It was, indeed, sad to watch how the current administrators are more interested in the monetary factor rather than the educational aspects that “our” Brothers were more interested in. The school premises are derelict, dirty and an ecological disaster. I heard that the current administration is looking at destroying the main office premises and building a multi-storied infrascture there. I talked to Brother Robi purification, the headmaster about it, reminding him that, at least that the premise should not be modified in order to preserve the heritage of our school. However, his intentions are more of a monetary nature than preserving the respect of once known as the best educational institution in Bangladesh. As an ex student of Brother Thomas, Brother Robert, Brother Ralph, Brother James and so many more awesome teachers, I am sad and mad at how the Purifications are spoiling the wonderful image and heritage of this great Bangladeshi educational instititution. I also wonder if the managing/advisory body and donors, some of whom who are also former students not thinking clearly as to how this institution is being ravaged, only for monetary greed. Time to take drastic steps to revive the glory of this great institution and honor the memory of our Brothers of the Holy Cross, the one’s who pioneered this great educational monument of Bangladesh.

    Like

Leave a comment